বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১০

শেয়ার ব্যবসার হালচাল

মুক্তি ফোন করেছে। আমি- বাজার কেন এমন, বাজার কখন ভাল হবে, বাজারের জন্য চিন্তা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি বলছি কিন্তু মুক্তি ফোনের অপরপ্রান্তে নিরুদ্বেগ আর প্রশান্ত। ধ্যুর চিন্তার কিছু নেই, বাজার উঠে যাবে। কথাবার্তা শেষ করে ফোন রেখেছি, আম্মা জানতে চান, বাজারে কী হয়েছে? হঠাৎ আমি বাজার নিয়ে এত টেনশনে কেন- আম্মার উদ্বিগ্ন চেহারা, সেখানে নানা প্রশ্ন। আমি হেসে বলি আম্মা এই বাজার সেই বাজার নয়-শেয়ার শেয়ার। আম্মা বলেন, 'ও'।
হাঁটতে বাজার বসতে বাজার, বাজারের শোরে সব একাকার। একটা গল্প বলি, ১৯২৯ সালে মূল্য ধসের আগে ওয়াল স্ট্রিটের ব্যবসার লোভে জন এফ কেনেডির পিতা সেখানে বিনিয়োগ করতে গিয়েছিলেন। একদিন ওয়াল স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে যাবার সময় তিনি শুনলেন স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনের সামনে এক বুট পালিশঅলা বলছে, ’buy oils and rails. They’re gonna hit the sky’.
অর্থাৎ তেল কোম্পানী আর রেলের. শেয়ার কেনো এগুলোর দাম আকাশ চুম্বি হবে। সে রাতে তিনি তার স্ত্রীকে বললেন, যে বাজারে সবাই খেলতে পারে এমন কি একজন বুট পালিশঅলাও ভবিষ্যদ্বানী করতে পারে, সে বাজার তার কাছে কোন বাজার নয়। তিনি সে সময় তার টাকা লগ্নি করেছিলেন রিয়েল এস্টেট বা ণির্মান ব্যবসায় এবং ব্যাপক লাভবান হয়েছিলেন। আর ১৯২৯ এর ওয়াল স্ট্রিটের ধস তো মহাপ্লাবনের মত ভয়ঙ্কর হয়েছিল সেটি সর্বজনবিদিত।
আর এই গল্পটিতো সবাই জানেন, একজন শেয়ার মার্কেটের দালাল দিনরাত লোহা, তামা বেচাকেনা করছেন। একদিন অফিসে তার কাছে বাড়ি থেকে ফোন এল, বাড়ির ঝি ফোন করেছে, বাবু গিন্নি মা পড়ে গেছেন।
এুণি বেচে দাও-আদেশ করলেন অন্যমনস্ক শেয়ার স্পেকুলেটর ভদ্রলোক- এক মিনিট দেরী না করে।
পড়ে যাওয়া মানে শেয়ারের দাম কমে ভুত হয়ে যাওয়া। এই সময় বেচা ছাড়া গতি কি! বেচারা কি আর বুঝতে পেরেছে তার বৌ পড়ে গিয়েছে।
আমাদের এইসব দিনরাত্রি কেমন কাটে? কোন কোন দিন এমন কাটে, কোন নিউজ নেই অথচ আইটেম কেনার জন্য যথেষ্ঠ পরিমাণ টাকা নিয়ে বসে আছি। আর কোনদিন কাটে একদম হাতখালি অবস্থায় অথচ আমার চারদিকে নিউজ আর নিউজ। মার্কেট চড়া থাকলে দ্বিতীয় অবস্থার আর মন্দা মার্কেটে প্রথম অবস্থার শিকার হই। চড়া মার্কেট এ মনের অবস্থা ভাল থাকবার কথা অথচ তখন মন খুব খারাপ থাকে, কারণ শেয়ারে শেয়ারে সব অর্থ লগ্নি করে বসে রয়েছি কিন্তু সোর্স বিভিন্ন আইটেমের খোঁজ দিয়ে চলেছে নতুন আইটেম কিনতে পারছিনা। মন্দা মার্কেটেও অবস্থা তথৈবচ। অর্থাৎ মন খারাপ। তারমানে বিজনেসে মন সর্বদা খারাপই থাকছে। এটিকে অবশ্য খারাপ না বলে উচাটন বলা যেতে পারে। লসের কারণে আমি অত্যধিক উত্তেজিত থাকিনা। এটি দীর্ঘদিনের অভ্যেসে গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। ২০০৭ সালের একটা আইটেম। ট্রেড ব্লক করে দিয়েছে আমার সহ আমার বন্ধুু বান্ধবীদের সবাইর ই মাথায় হাত। কিন্তু কিছু করার নেই ট্রেডিং নাই লস দিয়ে যে বের হবো সে উপায়ও নেই। সেই শেয়ার ২০০৭ এর পর এই ২০১০ এ এসে আলোর মুখ দেখলো। মজার ব্যাপার হলো সেই শেয়ার এই পর্যন্ত আমাকে ২০০% বোনাস শেয়ার উপহার দিয়েছে, এই উপহার কি ২০০৭ এ পেতাম? তাই মাইনকা চিপার কারণে শেয়ারটা ধরে রাখলেও এটাকে এখন আশীর্বাদ শেয়ার হিসেবেই দেখছি। উল্টোদিকও আছে। এবং এটাই বেশিবার সংঘটিত হয়েছে। পাক্কা নিউজ, আমার বস বলেছে এটি কিনলে নিশ্চিত লাভ। লসের কোন কারণ নেই। কিনলাম, বন্ধু-বান্ধবদেরও কিনতে বললাম। কেনার পর দিন থেকে দাম শুধু কমে আর কমে। মাথায় হাত। এখনো মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি।
৯৬ এর বাজারে আমি ছিলাম না। আমার দুই সিনিয়র ভাই এক ঘরোয়া আড্ডায় সেই বাজার নিয়ে মজার সব গল্প করছিলেন। একটি বলি। তখন ছিল কাগজের শেয়ার। সেই বাজারে বিভিন্ন কোম্পানীর শেয়ার সার্টিফিকেট হাতবদল প্রক্রিয়া অনেকটা পিলো পাসিং এর মতো হয়ে গিয়েছিল। কেউ শেয়ার সার্টিফিকেট হাতবদল করতে পারলেই লাভবান হয়ে উঠছিলেন, ঘুরতে ঘুরতে যাদের হাতে শেয়ার আটকে যায় তারা খান রাম ধরা। সেই শেয়াররূপী কাগজের আজ কোন দাম নেই।
বর্তমানের বাজারকে কোন ভাবেই মার্কেট ইকোনমির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বাজার বলা যাবে না। শেয়ার বাজারে অত্যধিক তেজীভাব আর্থিকবাজারে যথেষ্ঠ সমস্যা সৃষ্টি করছে। এইধরণের বুল মার্কেট বেরিশ বা মন্দাভাবের কবলে পড়বে যে কোন সময়। ভাল ফান্ডামেন্টালের শেয়ারের দাম বাড়ছেনা চিপ শেয়ারের দাম কোন কারণ ছাড়াই বেড়ে যাচ্ছে। স্পেকুলেশনের তোয়াক্কা না করে বাই সেল হচ্ছে। জানি না এই ধরণের অবস্থা কোন খাদের কাছে আমাদের নিয়ে যাবে।
যাই হোক কাউকে আতঙ্কগ্রস্থ করার জন্য এই লেখা নয়। বাজারে যারা আছেন এবং যারা আসছেন তারা কিছু দরকারী তথ্য মাথায় রেখে শেয়ারে আপনার অর্থ লগ্নি করবেন।
সাতটি জিনিসের উপর জ্ঞান রাখতে হবে- পেইড আপ ক্যাপিটেল, ক্যাপিটেল গেইন অব মার্কেট, আর্ণিং পার শেয়ার, ডিভিডেন্ড পার শেয়ার, প্রাইস বুক ভ্যালূ রেশিও, রাইট/বোনাস শেয়ার, প্রাইস আর্ণিং রেশিও, ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড, ডিভিডেন্ড পেমেন্ট রেশিও। এছাড়াও মনে রাখতে হবে।
১)বর্তমানে কোম্পানী যে প্রতিযোগিতায় সম্মুখীন হচ্ছে এবং সামনে হতে কি প্রতিযোগিতায় তারা পড়তে পারে তা নীরিক্ষণ করতে হবে।
২)কোম্পানী কর রেয়াতী সুবিধা ভোগ করছে কি না, কোম্পানীর সংরক্ষিত তহবিলের পরিমাণ, তাদের বছরান্তের ডিভিডেন্ড দেবার রীতি, মুদ্রা সরবরাহ, আর্থিক নীতি এবং সুদের হার সম্পর্কে জানতে হবে।
৩)কোম্পানীর উদ্যোক্তা পরিচালকরা ঋণ খেলাপি বা অন্য কোন আর্থিক অনিয়মের সাথে জড়িত কি না সে সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।
৪)কোম্পানীর যদি দেশী-বিদেশী যৌথ মালিকানা থাকে তা হলে ব্যবস্থাপনায় বিদেশী ফার্মের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু এগুলো বুঝতে হবে।
৫)কোম্পানী যদি দেশী-বিদেশী মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হয় তা হলে বিদেশী বিনিয়োগকারীর একসাথে বেশী শেয়ার বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে কি না তা খেয়াল রাখতে হবে।
শেয়ার ব্যবসা মানে ফটকা ব্যবসা। কিন্তু বর্তমানে বিনিয়োগের প্রচন্ড আকালের অবস্থায় এই ব্যবসায় সবার আগ্রহর সূচক প্রতিদিনই বাড়ছে। ব্যাপক সংখ্যক লোকের আগমণে এই ব্যবসাই এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।



সুত্র

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন